২০২৪ সাল। এই সময়টাতেও এসে কি ইন্টারনেট ছাড়া একটা দিন কল্পনা করা যায়? কিন্তু অচ্ছুত কারণে ইন্টারনেট ছাড়া দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। এই লেখাটি যখন লিখা শুরু করেছি তখন টানা চার দিন ইন্টারনেট বিহীন অবস্থার মধ্যে আছি। আরও কতদিন এভাবে থাকবে তা অজানা।
এভাবে থাকতে থাকতে মনে করার চেষ্টায় আছি, একটা সময় তো এসবের বালাই ছিল না তখন কীভাবে দিন কাটাতাম?
আস্তে আস্তে পেছনে ফেরার চেষ্টা যদি করি, তবে আজ থেকে ১০/১১ বছর আগে স্মার্ট ফোন অল্প বিস্তর তখনো ছিল, তবে ইন্টারনেটের গতি ছিল অপ্রতুল। স্বাভাবিক ভাবে সব জায়গায় সমানভাবে ইন্টারনেট ব্যাবহার করা যেত না। তখন ছিল টুজি ইন্টারনেটের যুগ। ঘরের ভিতর মোবাইল ইন্টারনেট পাওয়া ছিল বিরল ব্যাপার। বিকাল বেলা যখন ক্রিকেট খেলতাম, তখন খেলার ফাকে, মাঠের কোণে বসে একটু আধটু ঢু মারতাম। তখন ফেসবুকে শুধু টেক্সট ও ছবি আপলোড করা যেত। ভিডিও প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব থাকলেও অনলাইনে লাইভ স্ট্রিম করা তখন ছিল অকল্পনীয়। অধিকাংশ ভিডিও শোয়ার হতো ব্লুটুথের মাধ্যমে। মাঝে মাঝে ভিডিও ডাউনলোড করতে পারতাম বিভিন্ন সাইট থোকে, দেখা যেত ৫ মিনিটের ভিডিও ডাউনলোড করতে ৩০ মিনিট সময় লেগে যেত। তখন আমাদের ফোনে কিছু গেইম থাকত যা ইন্টারনেট ছাড়া খেলা যেত।
তারও কিছু আগে সদ্য কৈশরে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট বিহীন শুধু এফএম রেডিও ও টিভি দেখে কিংবা বই পড়ে দিব্যি সময় কাটিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আজকের এই সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে এতবেশী ডুবে গেছি যে, এসব ছাড়া থাকা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। জানি ইন্টারনেট নেই তবুও বার বার আঙ্গুল ফেসবুক অ্যাপ খুলতে যাচ্ছে। একটু পরপর মন খুচ খুচ করছে। টেলিভিশন দেখে সময় কাটাতে পারছি তবে কেন জানি টেলিভিশন দেখতেও বিরক্ত লাগছে। অনর্থক অ্যাড দেখতে হচ্ছে, বিগত পাঁচ/ছয় বছরে এমন অভিজ্ঞতা থেকে দূরে ছিলাম তার জন্য হয়ত।
টিভি দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে বই পড়া শুরু করলাম। ভাগ্য ভাল বই পড়ার একটি অ্যাপসে বিভূতিভূষণের একটি উপন্যাস ডাউনলোড করা ছিল আগে থেকে। উপন্যাসের নাম অরণ্যক। আর কোন উপায় না পেয়ে সেটাই পড়া শুরু করলাম। বিভূতিভূষণের সাথে হারিয়ে গেলাম অর্ধশত বছর পূর্বে, কলকাতা থেকে বহূদূরের একটি অরণ্যে, নিকটতম রেল স্টেশন যেখান থেকে ৩২ মাইল দূরে। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ডাক যোগাযোগ, চলাচলের প্রধান বাহন ঘোড়া।
লেখক সেখানে কলকাতার জাঁকজমক ছেড়ে সেখানে মিশে যেতে গিয়ে আবিষ্কার করেন সেই অরণ্যের নিগূঢ় বাস্তবতা যা কলকাতা শহরে বসে শুনলে শুধুই হাসির খোড়াক মনে হতো।
লেখক কলকাতা ছেড়ে সেই অরণ্যে বই ও বন্ধুবান্ধবদের আড্ডা ছাড়া থাকতে থাকতে যখন অসহ্য হয়ে উঠেছেন তখন তিনি ওই ঘন অরণ্যে নির্জনে একা সংসার পেতে বসে থাকা এক বৃদ্ধ যার স্ত্রী-সন্তান গত হয়েছে ১৪ বছর আগে, তাকে জিজ্ঞেস করেন জয়পাল কি করো বসে? এই যে এখানে একা থাকো, কারো সাথে কথা বলো না, এক গেয়ে লাগে না? জয়পাল অবাক হয়ে উত্তর দেয় খারাপ লাগবে কেন হুজুর? বেশ থাকি। জয়পালের উত্তরে লেখকের বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে যায় বহুগুণ। লেখক ভাবনায় ডুবে যান, মানুষ হয় কোন কাজ করে, নাহয় বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা, না হয় বই সিনেমা, ঘুরে বেড়ানো ছাড়া কীভাবে থাকে? লেখক অতীতে ডুব দেন, তিনি যখন স্কুলের নিচের ক্লাসে পড়তেন, স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে আসেন, বিএ ক্লাস পাশ করেন, তখনো জয়পাল এখানে এভাবে বসেই ছিল।
আমি ২০২৪ সালে ঢাকায় বসে ভাবছি জীবনের সব অনুষঙ্গের মাঝে থেকেও শুধু ইন্টারনেট ছাড়া মানুষ কীভাবে থাকে?
– আইমান মুজাহিদ
নিউজের ©সর্বস্বত্ব নবকণ্ঠ কর্তৃক সংরক্ষিত। সম্পূর্ণ বা আংশিক কপি করা বেআইনী , নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।