বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান কি চুড়ান্ত ?

ছরোয়ার হোসেন  :-
1233445677
শুক্রবার রাতে ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা হয়। হামলাকারীরা কমপক্ষে ২০ জিম্মি ও দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইসলামপন্থি উগ্রপন্থিদের সক্ষমতার চিহ্ন রেখে গেছে। এ যাবৎ তারা হত্যাকাণ্ডে সফল হয়েছে। তারা বেশির ভাগই ইসলামের সমালোচক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যা করেছে।
পুলিশ বলেছে, শুক্রবারের হামলায় নিহতদের মধ্যে ৯ জন ইতালির নাগরিক, ৭ জন জাপানি,  ২ জন বাংলাদেশি, একজন মার্কিনি ও একজন ভারতীয়।

 

এ হামলা আরো বলে দেয় যে, বাংলাদেশের উগ্রপন্থিরা তাদের নেটওয়ার্ক আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসলামিক স্টেটের বিস্তার কমানোর চেষ্টা করছে। সেক্ষেত্রে এ ঘটনা একটি মূল উদ্বেগের বিষয়।
বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের বেশির ভাগই সুন্নি মুসলিম। এর মধ্যে রয়েছে ২৫ বছর বয়সী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যুবক। এটাই ইসলামিক স্টেটের সদস্য সংগ্রহের একটি মূল্যবান ক্ষেত্র। উল্লেখ্য, ইসলামিক স্টেট এখন ইরাক ও সিরিয়ায় তাদের মূল উৎপত্তিস্থলে তীব্র চাপের মুখে রয়েছে। এ গ্রুপটি বিশ্বের যেকোন স্থানে তাদের মিশন চালাতে পারে বলে তাদের ওপর নজর রাখছেন পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ইসলামিক স্টেট এখন হামলা চালাচ্ছে বেসামরিক টার্গেটে। তারা এর আগে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। তা থেকে তাদের কর্মকাণ্ড পরিবর্তিত হয়েছে।

 

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো শাফকাত মুনীর বলেছেন, সার্বিক হুমকিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে আমাদেরকে। এ বিষয়ে সতর্কবার্তা ছিল, লক্ষণ ছিল, সবকিছুই ছিল। কিন্তু এত ব্যাপক আকারে এই নৃশংসতা ঘটবে এমনটা আমরা আন্দাজ করতে পারিনি।
রোসিনি আর্জেন্টিনার ক্যাবল নিউজ স্টেশন চ্যানেল ৫ নোটিসিয়াসকে বলেছেন, ভেতরে অনেক বিদেশি ছিলেন। হামলাকারীরা মূলত তাদেরকেই খুঁজছিল। তারা বিদেশিদের হত্যা করলেও রেস্তরাঁর কর্মকর্তা- কর্মচারী ও বাংলাদেশি অন্যদের প্রতি ভদ্রতা ও বিনয় প্রদর্শন করেছে।
রেস্তরাঁর স্টাফদের তারা আস্থায় নিয়েছিল। তবে বিদেশিদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ছিল যে, তারা স্বল্প পোশাক পরে ও মদ পান করে। এটা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ। একজন জঙ্গি বলেছিল, বিদেশিদের লাইফস্টাইল একই কাজ করতে স্থানীয় মানুষদের উৎসাহিত করছে।সুমীর বাড়ৈ বলেছেন, হামলাকারীরা সবাই ছিল স্মার্ট ও হ্যান্ডসাম। যদি আপনি তাদের দিকে তাকান তাহলে কেউই বিশ্বাস করতে পারবে না যে, তারা এ কাজ করতে পারে। ভোরের আগে আগে হামলাকারীরা ধর্মীয় বক্তব্য দিতে থাকে জিম্মিদের উদ্দেশে। কিচেনের স্টাফদের এ সময় তারা নিয়মিত নামাজ ও পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের নির্দেশনা দেয়।
একেবারে ভোরে অস্ত্রধারীরা হিজাব পরা একদল নারীকে মুক্তি দেয়। ফারাজ হোসেন নামে এক বাংলাদেশি যুবককেও চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়। এ কথা বলেছেন, ফারাজ হোসেনের ভাতিজা হিশাম হোসেন। ফারাজ হোসেন এমোরি ইউনিভার্সিটির ছাত্র। তার সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমা পোশাক পরা দুজন নারী। এক পর্যায়ে অস্ত্রধারীরা ওই দু’নারীকে জিজ্ঞেস করে তারা কোথা থেকে এসেছেন। জবাবে তারা জানান, একজন ভারত ও একজন যুক্তরাষ্ট্রের। ফারাজ হোসেনের আত্মীয়রা বলেছেন, অস্ত্রধারীরা যখন ওই দু’নারীকে মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানায় তখন ফারাজ হোসেনও তাদেরকে ভেতরে রেখে বেরিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। শনিবার সকালে যাদের মৃতদেহ পাওয়া যায় তার মধ্যে ছিল ফারাজের দেহ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বলেছেন,বেসরকারি স্কুল কলেজে লেখাপড়া করেছে। এরা ধনী পরিবারের সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। তিনি বলেছেন, এরা কেউই কখনো মাদ্রাসায় পড়তে যায়নি।
(এরা কিভাবে জঙ্গী হলো এটাই এখন সাধারন নাগরিকদের জিজ্ঞাসা )

তিনি দাবী করেন, তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা দেশের ভেতরেই বেড়ে ওঠা স্থানীয় জঙ্গি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেছেন, হামলাকারীরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশে বা জেএমবির সদস্য।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকেই ধারণা করছেন, বেসরকারি এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষিত তরুণদের মগজ ধোলাই করে রিক্রুট করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ বলছেন, প্রত্যক্ষভাবে দুর্বল হবার কোন কারণ নেই।

তবে এ ধরণের হামলার সাথে যেহেতু রাজনীতির একটি সংযোগ থাকে সেহেতু এটাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে, বলেন প্রফেসর রিয়াজ। তিনি বলেন, সামরিকভাবে কোনও অবস্থাতেই জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করা সম্ভব না।

“বিশেষ করে যখন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্তির এক ধরণের প্রমাণই যখন পাওয়া যাচ্ছে, সেই অবস্থায় কেবলমাত্র সামরিকভাবে হবে না। একটা রাজনৈতিক কৌশল থাকতে হবে, যাতে করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত করা যায়”।  প্রফেসর রিয়াজ এজন্য সরকারকে একটি জাতীয় ঐক্যমত্যের উদ্যোগ নেবারও পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন, এ বিষয়ে সকলকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেই অন্তর্ভুক্তির একটি পদ্ধতি বের করতে হবে। যাতে করে সমাজের যে সব শক্তি এই সব উগ্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আছে তাদেরকে একত্রিত করা যায়। সমাজেরমধ্যেই আসলে বিভিন্ন ধরণের শক্তি আছে বাংলাদেশের উগ্র সহিংসতার বিরুদ্ধে, তার চেয়ে বড় শক্তি আসলে আর কেউ নেই। সেটাকে যুক্ত করতে পারবে কি না বর্তমান সরকার, সেটা নির্ভর করছে তারা এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কি না। তারা রাজনৈতিক ভাবে এটা মোকাবেলা করতে চান কি না। নাকি তারা যে কৌশল গ্রহণ করে আসছেন সেটাকে অব্যাহত রাখতে চান”

বাংলাদেশের সরকার প্রথম থেকেই দেশটিতে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর উপস্থিতির কথা অস্বীকার করে আসছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পর্যন্ত সবাই সবসময়ে বলে আসছে, বাংলাদেশে যত জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয় তার জন্য স্থানীয় জঙ্গি গোষ্ঠী দায়ী। কখনো কখনো তারা বিরোধী দলকেও দায়ী করেন। জঙ্গি বিরোধী সরকারের এই অবস্থান এবং বর্তমান কৌশল কৌশল কার্যত সফল হচ্ছে না বলে মনে করেন প্রফেসর রিয়াজ।

তিনি বলেন, “এখন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার যাতে সমাজের, সিভিল সোসাইটির, বিরোধী দলের সবাইকে একত্রিত করে একটা জাতীয় ঐক্য তৈরি করা যায়।”

“রাজনৈতিক মতপার্থক্যগুলোকে যতদূর সম্ভব দূরে রেখে এবং যতদূর সম্ভব ঐক্যমত্য তৈরি করেই অগ্রসর হতে হবে”।

বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, কাল বিলম্ব না করে আসুন আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে দলমত নির্বিশেষে সন্ত্রাস বিরোধী ঐক্য গড়ে তুলে শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে মত ব্যাক্ত করেন। এই পরিস্থিতিতে সকল দল মতের ব্যাক্তিদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে সক্ষম না হলে বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ ভূ-খন্ড আন্তর্জাতিক জঙ্গীবাদের উত্থান চুড়ান্ত রূপ ধারন করবে ।

চলবে… লেখকের একান্ত মতামত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.