মন্টিপলিজ ইউনিভার্সিটি, ফ্রান্স।
আমি ‘পর্তুগালকে’ আটলান্টিক পারের রূপসী কন্যা বলে ডাকি। ডাকবোনাই বা কেনো? এই দেশের মাটি বাতাস পানি নদী ও পুরনো শহরগুলোর প্রেমে তো আমি পড়েছিলাম। এই দেশটিতে লন্ডনে ক্যানারি ওয়ার্ফের মতো নেই উঁচু উঁচু ব্যাবসায়িক দালান। পর্তুগালের বাতাসে নিউ ইয়র্কের মতো বড় বড় ঢলারের গন্ধ পাওয়া যায়না। অথবা দুবাই কাতারের মতো মার্বেল পাথর দিয়ে খোদাই করা বুর্জ অব দুবাইয়ের মতো চোখ ধাঁধানো অট্টালিকা নেই এখানে। তবে এখানে আছে এক অকৃতিম ভালোবাসা, মায়ার টান। যা এখানে না ঘুরে গেলে উপলব্ধি করা যাবেনা। জানিনা কেনো লাগোস, লিসবন ও পরতুতে এই অসম ভালোবাসার টান অনুভব করলাম। তা আটলান্টিকে স্রোতে ভেসে আসা পৃথিবীর সকল ভালোবাসা পর্তুগালের শহরগুলোতে লেপ্টে পড়া ভালোবাসা না ইবনে বতুতার রেখে যাওয়া কোন অলৌকিক আকর্ষন, যা তার মতো ভ্রমনপিয়াসুদের জন্য পর্তুগালের জন্য। আপনারা ইবনে বতুতার নাম শুনারই কথা যিনি পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন, তার দেশই হচ্ছে শান্ত ও ভালবাসার দেশ এই পর্তুগাল। বর্তমান সময়ের ফুটবল তারকা রোনালদোর দেশ পর্তুগাল।
২০১৬ সালের জুলাই মাসে দুই সপ্তাহের জন্য আমরা ১৫ জনের একটি গ্রুপ দুটি মিনিবাসে করে ফ্রান্স থেকে পর্তুগালের উদ্দেশে্য রয়ানা হই। যার মধ্যে আমি এবং রাজু বাংলাদেশী আর বাকিরা সবাই ফ্রেঞ্চ। মিনিবাসে করে পর্তুগাল দূরের পথ। তাই পথিমধ্যে দুই রাত আমরা স্পেনের দুটি শহরে ক্যাম্পিং করে থেকেছি। শহর দুটির নাম এই মূহুর্তে স্মরনে নেই।
সফরের তৃতীয় দিন দুপুরের দিকে আমরা প্রথম পর্তুগালের লাগোস শহরে প্রবেশ করলাম। শহরে ঢুকতেই আমি আঁচ করতে পারলাম এখানকার মানুষের মাঝে অন্যান্য ধনী দেশের মানুষের মত অস্থিরতা নেই। বাড়ি ঘর দোকান পাটগুলো তৈরী সম্পূর্ণ সাধারণ মানের। মানুষের হাঁটা চলাচল শান্ত। ট্রেনের মধ্যেও কোন হুড়হুড়ি নেই। দুপুরের খাবারের জন্য একটি শপিং মলে ঢুকতেই বুজতে পারলাম এখানকার দ্রব্য মুল্যের দামও বেশ স্বল্প।
আগে থেকে পর্তুগালে বসবাসরত আমার বন্ধু ভাই আত্মীয় স্বজনের থেকে জেনেছিলাম পর্তুগাল মাঝারি মানের ইনকাম থাকলে পর্তুগাল জীবন যাপনের জন্য একটি আরামের দেশ। আমি প্রথম যাত্রাতেই তার প্রমাণ পেলাম।
যাই হোক দুপুরের খাবার শেষে আমাদের পনেরো জনের দল আটলান্টিকের বুকে সাঁতার কাটতে রওয়ানা হলাম। আটলান্টিকের চরে যেতেই আমার চোখ তো চড়কগাছ। হাজার হাজার মানুষ আটলান্টিকের শান্ত জলে সাঁতার কাটছে। অনেকে কড়া সূর্য্যের আলোর নিচে ছোট ছোট প্লাস্টিকের ছাউনিতে বিশ্রাম নিচ্ছে, বই পড়ছে অথবা তার প্রিয়জনের সাথে একান্তে গল্প জমাচ্ছে। আমার কাছে এই দৃশ্যগুলো অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। আমরা বাংলাদেশিরা সচরাচর এইসব দৃশ্যে অভ্যস্ত নই বলে। আমার জন্য একটু বেশী অদ্ভুত লাগার কথা আমার যে কখনো বাড়ীর পাশে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতও ঘুরে দেখা হয়নি। সারাদিন সাঁতার কেটে সাগর পারে কিছুটা বিশ্রাম নিলাম। বিকেলের দিকে সূর্য্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লে ছুটলাম ক্যাম্পিং খোঁজার উদ্দেশ্যে। কাছেই একটি ক্যাম্পিং পেয়ে গেলাম। সবাই আসবাব পত্র নিয়ে নিজ নিজ তাঁবু মেরামতের জন্য ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। এইগুলো কাপড়ের তাঁবু যাকে বলা হয় ‘টেন্ট’। লাগোসে তিন দিন অবস্থান করে চতুর্থ দিন সকালে লাগোস থেকে প্রায় একদিনের পথ পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
সন্ধ্যার দিকে লিসবনের অদূরে ছোট্ট একটি গ্রামে আবারো তাঁবু গাড়লাম ওখানেই রাত কাটালাম। পরদিন সকালে রাজধানী লিসবনে যাত্রার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম। লিসবন ভ্রমণের জন্য আমার মাজে একটু বেশী উৎসাহ কাজ করছিলো। কারন ওখানে অলি চাচা, গুলজার ভাই, আশিকসহ আরো অনেক পরিচিতদের বসবাস এবং অনেকদিন পর তাদের সাক্ষাতের জন্য এক্সাইটেড ছিলাম। দুপুরের দিকে লিসবন পৌছলাম। লিসবনের রাস্তা ঘাট, আটলান্টিক পার চারিদিকে ভ্রমন কারীদের ভিড় আর ভিড়। এখান লন্ডন প্যারিসের মতো মানুষকে ব্যাস্ত দেখাচ্ছিলোনা। সবাইকে রিলাক্স মোডে আবিষ্কার করলাম। বিদেশি ভ্রমনকারীদের মধ্যে ইংলান্ড ফ্রান্স ও আ্যামেরিকানদের ভিড় বেশী লক্ষ্য করলাম।
আগে থেকে জানতাম লিসবনে প্রচুর বাংলাদেশিদের বসবাস। কিন্তু লিসবন যে একটি ‘মিনি বাংলাদেশে’ পরিনত হয়ে আছে তা কল্পনাতেই ছিলোনা। লিসবনের রাস্তার দু পাশ দিয়ে বাংলাদেশি দোকান পাট ও রেস্টুরেন্টে ঠাসা, বুজার উপায় নেই এটা ঢাকা শহরের কোন গলি না লিসবনের। আমি প্রতিটি বাংলাদেশি দোকানে একবার করে হলে ও ঢুঁ মারার চেষ্টা করেছি। অনেকদিন হলো বাংলায় কথা বলা হয়নাই, তাই নিজের দেশের মানুষদের কাছে পেয়ে সবাইকে অতি আপন মনে হলো। আমার সাথে থাকা ফ্রেঞ্চ ফ্রেন্ডরা এতো বাংলাদেশিদের লিসবনে বসবাস দেখে অবাক। তাদেরও বিশ্বাস হচ্ছিলোনা এটা কিভাবে সম্ভব। আমি প্রতিটি বাংলাদেশীর সাথে সাক্ষাত ও কথা বলার চেষ্টা করায় আমার ফ্রেন্ডগুলো বারন করেছে, তাদের যুক্তি হলো হোক না তারা বাংলাদেশী কিন্তু তারা তোমার পরিচিত না, সুতরাং অপরিচিতদের সাথে কথা না বলাই ভালো।
কিন্তু লিসবনের বাংলাদেশী ভাইদের ওয়েলকামিং রেসপন্স দেখে ফ্রেঞ্চ বন্দুরা অভিভূত হয়েছে। বাংলাদেশী অনেক দোকানদার ভাইয়েরা আমাকে গিফট দিয়েছেন, আমার সাথে থাকা ফ্রেন্ডদের জন্যও হাতের ব্রেসলেট, চশমা, টি-সার্টসহ এই রকম ছোট ছোট নানান গিফট দিতে কার্পণ্য করেননি। নিজের দেশের মানুষের প্রতি এই আন্তরিকতা ভালবাসা দেখে আমার বিদেশি ফ্রেন্ডগুলো অবাক হয়েছে। তারা বলছিলো আমাদের দেশে এইগুলো কেউ করেনা, হোক না নিজ দেশী তবু অপরিচিতদের সাথে এমন আন্তরিকতা কেউ দেখায়না। সত্যিকার অর্থে আমার বাংলাদেশী ভাইয়েরা বিদেশি বন্ধুদের কাছে আমার মাথাকে উচুঁ করেছেন। করেছেন দেশের মাথাকে উচুঁ ও সম্মানিত। আমি আমার দেশের মানুষের আতিথেয়তার এই মানসিকতা নিয়ে গর্ববোধ করি। লিসবনে তিন দিন ভ্রমন করে কেটে গেলো। এখানেও সাগরে সাঁতার কাটলাম, কিছু কেনাকাটা করলাম, সাগরের মাছ দিয়ে পর্তুগিজ রেস্টুরেন্টে দু বেলা খাবার খেলাম। লিসবনের স্পেশালিটি হচ্ছে সাগরের ‘সারডিন মাছ’। যা পৃথিবী জুড়ে এখান থেকে রপ্তানি করা হয়।
তিনদিন লিসবন সফর শেষে পর্তুগালের পুরাতন রাজধানী ‘পরতুর’ উদ্দেশ্যে আরো তিনদিনের জন্য রওয়ানা দিলাম। এখানেও তাঁবু করলাম। প্বার্শবর্তী শপিং মল থেকে তিনদিনের বাজার করে নিলাম। রাতের খাবার শেষে ক্যাম্পিংয়ে একটু ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ক্যাম্পিংয়ে অবস্থানকারীদের বেশীর ভাগই আমাদের মত স্টুডেন্ট। যারা গ্রুপ গ্রুপ হয়ে এসেছে সামারের ছুটিতে কিছুদিন পর্তুগালে কাটানোর জন্য। পরদিন সকালে পর্তুগালের সবচেয়ে পুরাতন শহর পরতু ঘুরে দেখলাম। পরতুর রাস্তা ঘাট, পুরাতন দালান বাড়ী এবং চার্চগুলো এই বুড়ো এবং পুরাতন শহরের সাক্ষ্য দিচ্ছিলো। পরতুতেও লিসবনের মত বাংলাদেশী দোকান পাটে ভরপুর। বাংলাদেশি ভাইদের সাথে কথা বলে বুজলাম এখানে তারা বেশ ভালোই আসেন। অন্নান্য দেশের মত সন্ত্রাসী হামলার ভয় নিয়ে পর্তুগালে তাদের ব্যাবসা বানিজ্য করতে হয়না। ইনকামের পরিমান কিছুটা কম হলেও তারা শান্তি সিকিউরড এবং আরামের জীবন উপভোগ করছেন। পুরতু অবস্থান কালে অনেক পুরোনো পুরোনো চার্চগুলো ভিজিট করলাম। ঢাকাকে যদি মসজিদের শহর বলা হয় তাহলে পরতুকেও চার্চের শহর বলা যায়। ঘুরলাম সাগরের বিভিন্ন রকমের প্রাণি দিয়ে সাজিয়ে রাখা ইয়া বড়ো অ্যাকুরিয়াম। সাগরে সাঁতার কাটা, আইসক্রিম খাওয়া লাগোস ও লিসবনের মত এখানেও নিয়মিত রুটিনে ছিলো।
ভ্রমণের শেষ দিন সকলের মন খারাপ। কারো ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। লাগোস, লিসবন ও পরতুর মায়া সকলকে পিছন থেকে টেনে ধরেছে। সকলের চেয়ে এই মায়া একটু বেশী আমাকে টেনে ধরেছে। এখানকার সাধারণ জীবন যাপন, দোকান পাট, রাস্তা ঘাট, নদী, সাগর সবকিছুতে যে আমি বাংলাদেশের ছাঁয়া খুজে পেয়েছি। আর দেশী মানুষের এত ভিড় আমি ফ্রান্সের যে শহরে থাকি ওখানে নেই বললে চলে। তবুও তো চলে যেতে হবে। নির্ধারিত সময়ের বেশি থাকার পরিকল্পনা নিয়েও আমরা আসিনি। অবশেষে রুপসী পর্তুগালের মায়া ভালবাসাকে পেছনে রেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছি। তবে রূপসীকে কথা দিয়ে এসেছি যখনই সময় পাবো তাকে আরেকবার ছুঁয়ে দেখতে, তার আটলান্টিকের বুকের অপর দিয়ে বয়ে চলা শান্তির নহর থেকে আরেকটু শান্তি উপভোগ করার জন্য আবার আসবো ! হয়তো বারবার আসবো। আমি যে এ রূপসীর প্রেমে পড়েছি।